Saturday, May 23, 2015

বায়োকলোনিয়ালিজম এবং খাদ্য রাজনীতিঃ টার্গেট বাংলাদেশ


প্রাণ-উপনিবেশীকরণ (Biocolonialism) পোস্টকলোনিয়াল হেজিমনিক ক্ষমতা কাঠামোরই নতুন রূপ। উপনিবেশীকরণ বলতে দেশ/ ভূমি দখলের যে ধারণা তার বদলে প্রাণ-উপনিবেশীকরণে আমরা দেখি অনুন্নত দুর্বল দেশগুলোর প্রাণবৈচিত্র্য, উদ্ভিদ, প্রাণী, অণুজীব, শস্য বীজ থেকে শুরু করে জিন পর্যন্ত বেদখল হয়ে যাচ্ছে কর্পোরেট আগ্রাসনে। প্রযুক্তিতে উন্নত দেশগুলো কর্তৃক অনুন্নত কিন্তু জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ দেশগুলোর হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী জেনেটিক সম্পদ ও লোকায়ত জ্ঞানকাঠামোর এই লুণ্ঠনকেই বায়োকলোনিয়ালিজম বলা হয়।
বিশ্বায়িত অর্থনীতিতে উন্নত দেশগুলোর বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলো কৃষিজ ও বনজ সম্পদে সমৃদ্ধ লোকাল জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী জ্ঞানকাঠামোকে কুক্ষিগত করার তাগিদে তথা উদ্ভিদ, প্রাণী, বীজ, জিন ও হারবাল মেডিসিনের মেধাস্বত্ব আদায়ের জন্য প্রচুর বিনিয়োগ করে থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বহুজাতিক কর্পোরেশনের এই তৎপরতা থেকে শুধু কোম্পানিই লাভবান হয়, অনুন্নত দেশের লোকায়ত জনপদ এসব জেনেটিক/ প্রাকৃতিক সম্পদের মূল মালিক হলেও তাদের স্বার্থকে নির্মমভাবে জলাঞ্জলি দেয়া হয়।
বায়োকলোনিয়ালিজম প্রতিষ্ঠার পেছনে কাজ করেছে দুটি প্রক্রিয়া-
১) প্রাণ ও জীবসম্পদের ( বীজ, উদ্ভিদ, প্রাণী, অণুজীব, জিন) পণ্যকরণ ও বাণিজ্যিকীকরন (Commoditization and commercialization of rural and indigenous bodies)
২) প্রাণ ও জীবসম্পদের বাণিজ্যিকীকরণকে তরান্বিত করার লক্ষে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে দেশে দেশে নিওলিবারেল পলিসির বাস্তবায়ন
গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান (যেমন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা) এবং বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলো এখন সাবঅলটার্ণদের ব্যাপারে বিশেষভাবে আগ্রহী কেননা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, তাদের ঐতিহ্যবাহী কালচার, জেনেটিক সম্পদ ও জীববৈচিত্র্য (Lives and Bodies of rural and indigenous populations) বিশ্বায়িত পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বাণিজ্য ও মুনাফার নতুন ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধাস্বত্ব চুক্তি কিভাবে বায়োপাইরেসি এবং মানুষের জেনেটিক সম্পদ শোষণের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে পশ্চিমের নয়া উপনিবেশিক শোষণকে জারি রাখে তার দিকে ইঙ্গিত করে গায়ত্রী স্পিভাক বলেন, “ বর্তমানে সাবঅলটার্ণ সম্পর্কিত ধারনা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। নিম্ন বর্গের লোকজন এখন আর কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, তথাকথিত কেন্দ্র ( হেজিমনিক উন্নত দেশগুলো) এখন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধাস্বত্বের উৎস হিসেবে গ্রামীণ ও লোকায়ত সাবঅলটার্ণদের বিবেচনা করছে [১]। গায়ত্রী মূলত এই উক্তির মাধ্যমে উপনিবেশীকরণের নতুন রূপের দিকে ইঙ্গিত করেন যার মাধ্যমে প্রান্তিক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বায়োলজিকে উপনিবেশে পরিণত করা হয়। বায়োকলোনিয়ালিজম যেমন উপনিবেশীকরণের সাথে সম্পৃক্ত তেমনি এর সাথে জড়িয়ে আছে বায়োপলিটিক্স/ বায়োপাওয়ার। ফুকোর বায়োপাওয়ার সম্পর্কিত ধারণাকে বায়োকলোনিয়ালিজম ধারনায় প্রয়োগ করে হানাহ বাট বলেন, “ফুকোর বায়োপাওয়ার যেমন ব্যক্তিসত্তাকে নিয়ন্ত্রণ করে তেমনিভাবে বায়োকলোনিয়ালিজমে আমরা দেখতে পাই বায়োলজি/ জীবস্বত্বাকে ( প্রাণের যে কোন প্রকাশ- জিন, জেনেটিক সম্পদ, উদ্ভিদ, প্রাণী, কোষ) আধুনিক রাষ্ট্র, বিশ্বায়ন এবং পুঁজিবাদের ধারণার সাথে সম্পৃক্ত করে জীবসত্ত্বা সম্পর্কিত ধারণা পাল্টে দেয়া হয় এবং জীবসত্বাকেও পণ্যকরণ ও বাণিজ্যিকীকরন করে বৈশ্বিক পুঁজির কাঠামোর সাথে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে দেয়া হয়” [২]। ফলে জীবস্বত্বাও এখন হয়ে উঠে দখলের নতুন জমিন, প্রাণ ও প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার প্যাটেন্ট বা মালিকানা দাবি করে গ্লোবাল কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো কে কত লোকায়ত জ্ঞানকাঠামো ও বায়োলজিক্যাল সম্পদ নিজের মালিকানায় নিয়ে আসতে পারবে তার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছে তারা। এই বায়োপলিটিক্স বা বায়োপাওয়ার এর সর্বোচ্চ প্রকাশ আমরা দেখতে পাই ডব্লিউটিও’র ট্রিপস চুক্তির ২৭.৩ (খ) ধারায় যেখানে প্রাণ ও প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার উপর পেটেন্ট করার অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
প্রাকৃতিক সম্পদ/ জীব বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ হলেও দক্ষিনের এই দেশগুলোর মালিকানা হারানোর পেছনে দায়ি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মত অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদী প্রতিষ্ঠানগুলো। বায়োপাইরেসি/ বায়োকলোনিয়ালিজম প্রতিষ্ঠার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে নিওলিবারেল অর্থনীতি। বিরাষ্ট্রীয়করণ, বিনিয়ন্ত্রণ, উদারীকরণ ও বেসরকারিকরণের মাধ্যমে ডব্লিউটিও যে নিওলিবারেল বিশ্বায়নের নীতি বাস্তবায়ন করতে চায় তা অনুন্নত দেশগুলোর লোকাল কমিউনিটির স্বনির্ভর অর্থনীতি ও কৃষি ব্যবস্থাপনাকে ভঙ্গুর করে তুলছে। মুক্ত বাজার অর্থনীতির আড়ালে ডব্লিউটিও মূলত বিশ্বব্যাপী এমন এক একমাত্রিক বাণিজ্য নীতি চালু করতে চায় যা তথাকথিত ট্রেড বাধাসমুহ দূর করে গ্লোবাল কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানসমূহের মুনাফা অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে। ডব্লিউটিও’র গ্যাটস ( জেনেরাল এগ্রিমেন্ট অন ট্রেড ইন সার্ভিসেস) দুর্বল রাষ্ট্রসমূহকে গ্লোবাল কর্পোরেট বাণিজ্য নীতির অধীনে নিয়ে আসতে চায়। এই চুক্তির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ক্রমান্বয়ে বাণিজ্য সম্পর্কিত রাষ্ট্রীয় বাধাসমুহ দূর করে এসব দেশের অর্থনীতি বিশেষ করে সেবা খাতকে বৃহৎ কর্পোরেশনের বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া।
খাদ্য রাজনীতি ও কৃষিতে কর্পোরেট মনোপলিঃ
১৯৯০ সাল থেকেই ডব্লিউটিও পরিণত হয়েছে খাদ্য সম্পর্কিত বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থাকে নিওলিবারেল নীতির ছাঁচে ঢেলে সাজানোর হাতিয়ারে। ডব্লিউটিও’র গ্যাট (জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন ট্রেড এন্ড ট্যারিফ) অথবা গ্যাটস (জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন ট্রেড ইন সার্ভিসেস) এর অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে কৃষি খাতকে বৈশ্বিক ভাবে উদারীকরণের দিকে নিয়ে যাওয়া এবং এগ্রিকালচারাল সংস্কারের নামে রাষ্ট্রীয় সংরক্ষণশীল বাধা সমুহ দূর করে অনুন্নত দেশের কৃষিতে বৃহৎ কর্পোরেশনের নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য পাকাপোক্ত করা। অর্থাৎ কৃষিতে ভর্তুকি হ্রাসকরণ করে দেশজ কৃষি উৎপাদন ব্যয়বহুল করা এবং বাণিজ্য সংক্রান্ত রাষ্ট্রীয় বাধা দূর করে বহুজাতিক কর্পোরেশনের কৃষিজাত দ্রব্যের বাজারে পরিণত করা। ডব্লিউটিও’র এগ্রিমেন্ট অন এগ্রিকালচার (AoA) কৃষিতে উদারীকরণের নামে অনুন্নত দেশগুলোর কৃষি ব্যবস্থার উপর বহুজাতিক এগ্রো কর্পোরেশনের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার দরজা খুলে দিচ্ছে। এওএ অনেক উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বহুজাতিক কোম্পানির হাইব্রিড এবং নন হাইব্রিড জিএম (জেনেটিক্যালি মোডিফাইড) শস্য চাষ করতে বাধ্য করছে। ফলে ঐতিহ্যবাহী লোকাল জাতের জায়গা দখল করে নিচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানির মালিকানাধীন জিএম শস্যজাত। বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলো দাবি করছে যে বায়োটেক জিএমও শস্য চাষ কীটনাশকের ব্যাবহার কমাবে এবং উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দূর করবে। তবে তাদের এই দাবির বিপরীতে অনেক বিশেষজ্ঞের মতে ডব্লিউটিও’র আধিপত্যবাদী কাঠামোর মধ্যে এই প্রযুক্তির ব্যাবহার ক্ষুদ্র কৃষক ও খামারের ধংস সাধন করবে, জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করবে এবং খাদ্য নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিবে। কৃষিতে এই কর্পোরেট মনোপলি স্থানীয় কৃষকদের নিজস্ব উৎপাদনশীলতাকে যেমন ধংস করছে তেমনি অনুন্নত দেশগুলোর খাদ্য সার্বভৌমত্বকে নস্যাৎ করে দিচ্ছে। শুধু কৃষিতে নয়, ডব্লিউটিও’র বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধাস্বত্ব অধিকার চুক্তির (TRIPS) ফলে কর্পোরেট জায়ান্টরা এখন দুর্বল অনুন্নত দেশগুলোর ঐতিহ্যবাহী হারবাল মেডিসিনকেও প্যাটেন্ট করে নিচ্ছে। ফলে লোকায়ত জনগোষ্ঠী নিজস্ব মেডিসিনের উপর নিয়ন্ত্রণ/ মালিকানা হারাচ্ছে।
গ্লোবাল এগ্রো কর্পোরেশনের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য উৎপাদন সম্পর্ক এবং উৎপাদন কাঠামোর পুনর্গঠনের মাধ্যমে গ্লোবাল কর্পোরেট খাদ্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। গ্রিনফিল্ড এর মতে, “ডব্লিউটিও একটা কর্পোরেট সাম্রাজ্যকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে যা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা ( Food Self Sufficiency) এবং খাদ্য নিরাপত্তার (Food Security) ধারণাকে কর্পোরেট বাণিজ্য ও মুনাফা অর্জনের পথে বাধা হিসেবে দেখে এবং যা এমন এক বৈশ্বিক ও দেশীয় আইন এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি করে যেন গ্লোবাল পুঁজিবাজারের প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণকে সুসংহত করা সম্ভবপর হয় ৩। এসব বহুজাতিক চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রকে গ্লোবাল পুঁজিবাজারের সাথেই সম্পৃক্ত করা হয়েছে এবং মূলত রাষ্ট্র নিজেই কর্পোরেট বডি আকারে ফাংশন করছে ৪। ম্যাক মাইকেল এর মতে “খাদ্য উৎপাদন ও ভোগে বৈচিত্র্যের বদলে মনোকালচার প্রবর্তন করে খাদ্য উৎপাদন ও ভোগ ব্যবস্থাপনার সম্পর্ক পরিবর্তন, টার্মিনেটর জিন ব্যাবহার করে বীজ মালিকানা কুক্ষিগত করার অপচেষ্টা এবং শ্রেণি ভিত্তিক খাদ্য রুচির প্রমোশনের মাধ্যমে গ্লোবাল এগ্রো কর্পোরেশনগুলো কৃষিতে জাতিগত ও কমিউনিটি কেন্দ্রিক উন্নয়ন ধারণাকে নাকচ করে দিয়ে গ্লোবাল নিওলিবারেল অর্ডার প্রবর্তন করে। ফলে লোকাল খাদ্য নিরাপত্তা, রাষ্ট্রীয় খাদ্য সার্বভৌমত্ব এবং গণমানুষের কল্যাণে খাদ্য সরবরাহ এসব ধারনার জায়গা দখল করে নিয়েছে গ্লোবাল কর্পোরেট ফুড রেজিম”৫। গ্লোবাল অর্থনীতির ৬৫% হচ্ছে এগ্রিকালচার এবং মাত্র ১০ টি বহুজাতিক এগ্রোকেমিক্যাল কোম্পানি এগ্রিবিজনেসের ৮১% নিয়ন্ত্রণ করে। দুনিয়ার সামগ্রিক বীজ বাজারের ৬৪ শতাংশ আজ দখল করে রেখেছে দশটি বহুজাতিক কোম্পানি।
ট্রিপস চুক্তি, প্রযুক্তি এবং বায়োপাইরেসিঃ
নতুন প্রযুক্তি মাত্রই নতুন সম্পদ সৃষ্টির মাধ্যম তা নয় বরং এই প্রযুক্তি সম্পদ লুণ্ঠনের হাতিয়ার হিসেবেও ব্যাবহার করা হতে পারে যদি এই প্রযুক্তির সাথে সংযুক্ত হয় আইনি আধিপত্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশের দেশিয় পেটেন্ট আইন এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধাস্বত্ব অধিকার আইনের ভিত্তিতে প্রযুক্তি এখন হেজিমনিক দেশগুলো কর্তৃক অনুন্নত দেশের প্রাকৃতিক সম্পদরাজি লুণ্ঠনের হাতিয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। গত দুই দশক ধরেই পশ্চিমা বিশ্বের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো যেমন মনসেন্টো, ইউনিলিভার, ডুপন্ট তৃতীয় বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী লোকায়ত জ্ঞান, প্রাণ বৈচিত্র্য তথা জেনেটিক সম্পদকে অবৈধভাবে পেটেন্ট করে নিয়ে এসবের উপর তাদের নিরঙ্কুশ মালিকানা প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। এ ধরনের পেটেন্ট আগ্রাসনের সুযোগ করে দিয়েছে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার ট্রিপস চুক্তির ২৭.৩ (খ) ধারা। ট্রিপস চুক্তির মাধ্যমে বহুজাতিক কোম্পানি কর্তৃক বিভিন্ন প্রকারের পণ্য ও প্রক্রিয়ার পেটেন্টকরণ এর সম্ভাবনা অনেকগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। এই চুক্তি এমনকি গ্লোবাল কর্পোরেশন কর্তৃক জেনেটিক সম্পদ যেমন বীজ জার্মপ্লাজম প্যাটেন্টের সুযোগ সৃষ্টি করেছে ফলে কৃষকগণ তাদের উদ্ভাবিত বীজের মালিকানা হারাচ্ছে। ট্রিপস চুক্তি অনুসারে জিনের প্যাটেন্ট দাবি করতে পারবে শুধু সরকার ও কর্পোরেশন – কৃষকগণ এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এই প্যাটেন্ট দাবি করতে পারবে না এবং এই চুক্তিতে ঐতিহ্যবাহী লোকায়ত জ্ঞানের উপর কৃষক ও কমিউনিটির স্বাভাবিক প্রাকৃতিক অধিকারের স্বীকৃতিও নাই (গ্রিনফিল্ড, ১৯৯৯)।
মার্কিন বহুজাতিক এগ্রো-কেমিক্যাল কর্পোরেশন মনসেন্টো, ইউনিলিভার ইত্যাদি বিভিন্ন দেশ থেকে শস্য বীজ সংগ্রহ করে গড়ে তোলে বিশাল শস্য বীজ ব্যাঙ্ক । এরপর উক্ত শস্যের জিনোম সিকোয়েন্স নির্ণয় করে যে জিনটি শস্যটির বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী তা সনাক্ত করে। লোকায়ত কৃষকদের বীজের সংরক্ষণ ও পুনরুৎপাদনের মাধ্যমে প্রাকৃতিক ক্রসিং (Natural combination) এর ফলে যে জিনের উদ্ভব তাকেই ল্যাবরেটরিতে সনাক্ত করে বহুজাতিক কোম্পানি তার মৌলিক উদ্ভাবনা বলে চালিয়ে দেয় এবং ঐ শস্য বীজের পেটেণ্ট করে নেয়। কোম্পানি পরবর্তীতে জেনেটিক রিকম্বিনেশনের মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত সমস্ত উদ্ভিদ, বীজ ও উদ্ভিদজাত সব পণ্যের উপর তার মালিকানা নিয়ে নেয়। কৃষিজ উদ্ভিদের যে বৈচিত্র্য, বিভিন্ন জাতের ও বৈশিষ্ট্যের যে সমাহার তা কিন্তু কৃষকদের বীজের সংরক্ষণ, পুনরুৎপাদন ও নবায়নযোগ্য ব্যাবহারেরই ফল। কোম্পানি কৃষকদের পরিশ্রম ও অভিজ্ঞতালব্ধ এই উৎপাদন প্রণালীকেই নিজস্ব উদ্ভাবন বলে দাবী করে শুধু মাত্র অর্থ ও প্রযুক্তির জোরে। এভাবেই তৃতীয় বিশ্বের কৃষক ও জনসাধারণের উৎপাদন প্রণালী উদ্ভূত বিভিন্ন শস্য বীজের জাত চলে যায় বহুজাতিক কোম্পানির মালিকানায়। এভাবে প্রাণ ও উদ্ভিদের পেটেন্ট হচ্ছে হাজার বছরের উন্নয়নশীল দেশের জ্ঞানের নীরব চৌর্যবৃত্তি। উদাহরণস্বরূপ ১৯৯৫ সালে মার্কিন কৃষি বিভাগ কর্তৃক বাংলাদেশের ওষধি গাছ নিম হতে প্রাপ্ত ছত্রাক বিরোধী ওষুধের পেটেন্ট, মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি মনসেন্টো কর্তৃক ১৯৯৯ সালে ভারতের উচ্চ বেকিং ক্ষমতা সম্পন্ন ‘ন্যাপ হাল’ গমের মেধাস্বত্ব দাবী, ২০০০ সালে মেক্সিকোর উচ্চ লিপিড সম্পন্ন বিশেষ ভুট্রার উপর ডুপন্ট এর স্বত্ব দাবী, বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের বাসমাতি চালের উপর যুক্তরাষ্ট্রের ‘ রাইসটেক’ কোম্পানির মালিকানা দাবী এবং ‘টেকনোমতি’ নামে বাজারজাতকরণ ইত্যাদি। এছাড়াও গাছের বিশেষ উপাদান যেমন প্রোটিন বা লিপিড এবং এসব উপাদান সমৃদ্ধ সমস্ত জেনেটিক সম্পদ, হাইব্রিড ব্রিডিং প্রণালীর সামান্য পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রাপ্ত সমস্ত বীজ ও উদ্ভিদ, টিস্যু কালচার প্রযুক্তির প্রয়োগে উদ্ভূত উদ্ভিদের জেনেটিক বস্তু, বাহ্যিক জিনকে (external gene) বিদ্যমান প্রজাতিতে প্রযুক্ত করে নতুন জিন বহনকারী সকল উদ্ভিদ এবং বীজকে নিজের বলে দাবি করে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি ডুপন্ট এবং পাইওনিয়ার এসব জৈবিক সম্পদের উপর পেটেন্টের আবেদন করে রেখেছে।
পশ্চিমা বহুজাতিক কোম্পানি কর্তৃক প্রাণবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ দেশগুলোর জেনেটিক সম্পদরাজির এই লুণ্ঠনকে আমাদের মত দেশের কর্মকর্তাগণ যে মেনে নিচ্ছেন তার পেছনে কাজ করে কালচারাল ইম্পারিয়ালিজম। ঐতিহাসিকভাবে পদানত সংস্কৃতির লোকায়ত জ্ঞান কাঠামো এবং প্রাকৃতিক/ সাংস্কৃতিক সম্পদকে পণ্যে পরিণত করা হলে এর সাথে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা সংযুক্ত হয়ে তৈরি করে এই কালাচারাল ইম্পেরিয়ালিজম। বর্তমান গ্লোবাল ক্যাপিটাল ওয়ার্ল্ড অর্ডার এ পশ্চিমা সংস্কৃতি আধিপত্যমূলক এবং ফলে ডমিন্যান্ট সংস্কৃতিতে মালিকানা ও সম্পত্তি সম্পর্কিত যে ধারনা তাদের আইন ও অর্থনৈতিক কাঠামোর মাঝে প্রোথিত আছে তাকে আমাদের এখানকার পণ্ডিতেরা মেনে নিচ্ছে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার প্যাটেন্ট আইন যে মালিকানা সম্পর্ক উৎপাদন করে তা মেনে নেয়ার প্রবণতা তৃতীয় বিশ্বের অনেক শিক্ষিত অনুগতদের মাঝে পরিলক্ষিত হয়। পশ্চিম তার আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক স্বার্থে প্রাণ ও প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার উপর যে পেটেন্ট আইন চাপিয়ে দিচ্ছে তাকেও জায়েজ মনে করছেন এদেশের কলোনিয়াল এলিট প্রজন্ম! পশ্চিমের কালচারাল ইম্পেরিয়ালিজমের আরেকটি বড় অনুষঙ্গ হচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে কোন উদ্ভাবন/ আবিষ্কারকেই আরাধনা করার মানসিকতা তৈরি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মাত্রই প্রগতি এই বিজ্ঞান-ধর্মী কুসংস্কার অনেকের মাঝেই দেখা যায়। ফলে জেনেটিক ইঞ্জিরিয়ারিং/ জিএম প্রযুক্তি মাত্রই মানব কল্যাণ সাধন করবে এই অন্ধ ধারনার কারনে বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলো জিএম’র মাধ্যমে সহজেই বায়োপাইরেসির মধ্য দিয়ে আমাদের মত দেশের শস্য বীজের মালিকানা ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হচ্ছে। বহুজাতিক এগ্রো কামিক্যাল কর্পোরেশনগুলো অন্যান্য পদ্ধতির চেয়ে জিএম টেকনোলোজি গ্রহণ করার কারণ হচ্ছে এর মাধ্যমে সহজেই প্যাটেন্ট আগ্রাসনের মাধ্যমে কৃষি বীজের ওপর কোম্পানির মনোপলি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সাথে রাজনৈতিক অর্থনীতির সম্পর্ক মানে মালিকানার সম্পর্ককে বাদ দিয়ে যারা বিবেচনা করেন তারা নিজের অজান্তেই বহুজাতিক কোম্পানির কাছে স্বদেশের সম্পদের মালিকানা তুলে দেয়ার এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন। জিএম দিয়ে পেটেন্ট আগ্রাসন চালিয়ে কোম্পানি যখন বায়োপাইরেসি করে আর এর মাধ্যমে আমাদের হাজার হাজার বছরের শস্যবীজের মালিকানা দাবি করে, তখন তাকে আর নির্মোহ বিজ্ঞান বলা যায় না— এটা করপোরেটের হাতিয়ার হিসেবেই কাজ করে।
প্যাটেন্ট আগ্রাসনের কবলে বাংলাদেশ:
বাংলাদেশের হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সম্পদ, প্রাণবৈচিত্র্য এবং কৃষিজ পণ্যের উপর একের পর এক মেধাস্বত্ব অধিকার তথা মালিকানা স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত করে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা থেকে বাংলাদেশের ফজলি আম ও জামদানি শাড়ির মালিকানা স্বত্ব নিয়ে নিয়েছে ভারত। ওষধি গাছ নিমের স্বত্ব নিয়ে গেছে প্রথমে যুক্তরাষ্ট্র এবং পরে ভারত। বাসমতির স্বত্ব নিয়েছে ভারত ও পাকিস্তান। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী নকশিকাঁথাকে পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করে ভারত বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার কাছে এর মালিকানা স্বত্বও দাবি করে রেখেছে । জিএম প্রযুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের নিজস্ব বেগুনের নয়টি জাতকে জেনেটিকালি পরিবর্তিত করে এসব বীজের মালিকানাও নিয়ে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মনসান্তো কোম্পানি।এভাবে একের পর এক আমাদের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক পণ্য, ওষধি গাছ এবং কৃষিজ শস্যের মালিকানা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে এবং এসব পণ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব।
জিএম বীজ কৃষিতে কর্পোরেট আধিপত্য প্রতিষ্ঠার নব্য হাতিয়ার:
বীজ নিয়ে বহুজাতিক কোম্পানির যে রাজনীতি তার নিষ্করুণ শিকার হচ্ছে বাংলাদেশের কৃষি ও প্রাণবৈচিত্র্য! ব্যাসিলাস থুরিনজেনসিস (বিটি) বেগুন চাষের অনুমোদন দেয়ার পর এবার জেনেটিক্যালি মডিফাইড (জিএম) আলুর ফিল্ড ট্রায়াল চলছে বাংলাদেশে, এই জিএম আলু প্রকল্প হচ্ছে মার্কিন সংস্থা USAID এর অর্থায়নে, উদ্দেশ্য এদেশের শস্যবীজের উপর মার্কিন কোম্পানির মনোপলি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। জেনেটিক্যালি মডিফাইড (জিএম) ধান গোল্ডেন রাইস, জিএম টমেটো, জিএম তুলাও আনার প্রক্রিয়া চলছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ এখন বহুজাতিক এগ্রো করপোরেশনের জিএম বাণিজ্যের উর্বর ভূমিতে পরিণত হচ্ছে। এভাবে একে একে কৃষিতে বীজ আগ্রাসন আমাদের হাজার বছরের বীজবৈচিত্র্যকে হুমকির মুখে ফেলে দিবে। ফলন বৃদ্ধির নামে বীজ মালিকানা নিজের দখলে নেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে এগ্রো জায়ান্টরা! ২০০৫ থেকে ২০১৪ সালে সম্পাদিত ‘বিটি বেগুন প্রকল্পের’ নামে মনস্যান্টো বাংলাদেশের নয়টি বেগুন জাত ছিনতাই করেছে। বিটি প্রযুক্তির মালিক মনসান্তো-মাহিকো হওয়ায় এবং এই দুই কোম্পানির কারিগরি সহায়তা ও মার্কিন সংস্থা USAID এর অর্থায়নে এই প্রকল্প চালু হওয়ায় তার মালিকানা কোম্পানির হাতেই থাকবে। ২০০৫ সালের ১৪ মার্চ বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি), মার্কিন বহুজাতিক বীজ কোম্পানি মনসান্তো পক্ষে ভারতীয় কোম্পানি মহারাষ্ট্র হাইব্রিড সিড কোম্পানি লিমিটেড (মাহিকো) ও ভারতীয় কোম্পানি সাতগুরু ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্ট প্রাইভেট লিমিটেডের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় যে সাব-লাইসেন্স চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, তাতে সুস্পষ্টভাবে লেখা আছে এ বিটি বেগুনের বীজের মেধাস্বত্ব মনসান্তো-মাহিকো কোম্পানির (ধারা ১.১৯) এবং তা বাংলাদেশের বারিকে কিনে নিতে হবে কোম্পানি থেকেই (ধারা ১.৬)। চুক্তির ধারা ৯.২ (গ)তে বলা হয়েছে, ‘This Agreement may be terminated by Sub licensor (read MHSCL) if in Sub licensor’s judgment, reasonably exercised, laws and regulations in the Territory (read Bangladesh) do not provide adequate assurance of protection for commercial and intellectual property rights, including, but not limited to: i) effective, legal and practical protection of Licensed Domestic Eggplant Products, the B.t. Gene and/or MHSCL Technology against unauthorized reproduction; and ii) implementation in the Territory of legislation affording protection for patented technology incorporated in living organisms.’ অর্থাত্ বিটি বেগুন বীজের ও প্রযুক্তির বাণিজ্যিক ও মেধাস্বত্ব অধিকারের সংরক্ষণ লঙ্ঘিত হলে কোম্পানি এ চুক্তি বাতিলের অধিকার রাখে! চুক্তির এসব ধারা অনুযায়ী প্রমাণিত হচ্ছে বাংলাদেশের বেগুন বীজের মালিকানা চলে যাবে মার্কিন-ভারতীয় কোম্পানি মনসান্তো-মাহিকোর কাছেই। এটা বায়োপাইরেসি ছাড়া আর কিছুই নয়। এসব গণবিরোধী চুক্তি বাংলাদেশের হাজার বছরের লোকায়ত জ্ঞান, বীজ সম্পদসহ সামগ্রিক কৃষি ব্যবস্থাকে বহুজাতিক কোম্পানির করপোরেট নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যাবে। বাংলাদেশে গোল্ডেন রাইস প্রবর্তনের জন্য বহুজাতিক কোম্পানি সিনজেন্তা এবং বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মধ্যেও একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। জিএম আলুর জন্যও চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, এসব চুক্তিতেও বাণিজ্যিক ও মেধাস্বত্ব অধিকার কোম্পানির বলেই বিশেষজ্ঞরা ভাবছেন।
এখন বাংলাদেশের বেগুন বীজের উপর মার্কিন ও ভারতীয় কোম্পানি মনস্যান্টো-মাহিকোর এই প্যাটেন্ট আগ্রাসনের বিরূপ প্রভাব কি হবে? প্রথমত বিটি বেগুনের বাণিজ্যিক ব্যাবহার বাংলাদেশে যে হরেক রকম জাতের বেগুন রয়েছে অর্থাৎ আমাদের বেগুনের জেনেটিক বৈচিত্র্যকে হুমকির মুখে ফেলে দিবে। বেগুন বীজের পেটেন্ট বহুজাতিকের কাছে থাকবে বলে এবং সরকারের পক্ষ থেকে অধিক ফলনের বিজ্ঞাপন দিয়ে বিটি বেগুন চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করা হলে শুধুমাত্র এই জিএম বীজের চাষাবাদে কৃষক নিয়োজিত থাকবে। কৃষকগণ নির্ধারিত কিছু জিএম জাতের ফলনের দিকে নজর দিবে ফলে ঐতিহ্যবাহী লোকায়ত জাতগুলোর জায়গা দখল করে নিবে জিএম বীজ। ফলে ধীরে ধীরে দেশি বীজের সংরক্ষণ ও পুনরুৎপাদন এর ধারাবাহিক প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া হারিয়ে যাওয়ার আশংকা থাকবে এবং এসব হরেক রকম বেগুন বীজ হারিয়ে যেতে পারে। ফলে বীজ নিরাপত্তা/ খাদ্য নিরাপত্তা চলে যাবে প্রাইভেট করপোরেশনের হাতে। দ্বিতীয়ত পরাগায়নের মাধ্যমে বিটি বেগুনের বাইরে জিনটি বাংলাদেশের নিজস্ব অন্য জাতের বেগুনে প্রবেশ করলে এসব জাতও জেনেটিক দূষণের কবলে পড়বে।
প্রাণ উপনিবেশীকরণে আমাদের ক্ষতিসমুহ
১। নিজেদের লোকায়ত জ্ঞান ও সম্পদের মালিকানা হাতছাড়া ঃ প্যাটেন্ট আগ্রাসনের মাধ্যমে লোকায়ত জনগোষ্ঠী নিজস্ব প্রাকৃতিক সম্পদের ও লোকায়ত জ্ঞানের মালিকানা হারায়।
২। খাদ্য নিরাপত্তা ও খাদ্য সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন এবং খাদ্যের জন্য কর্পোরেটদের উপর নির্ভরশীলতাঃ
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ট্রিপস চুক্তি এবং এগ্রিমেন্ট অন এগ্রিকালচার পুরাপুরি বাস্তবায়িত হলে দরিদ্র দেশগুলোর লক্ষ লক্ষ কৃষক এর জীবন জীবিকা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে তেমনি বহুজাতিক এগ্রো কর্পোরেশনের কর্পোরেট মনোপলি এবং মনোকালচারের কারনে এসব দেশের প্রাণ বৈচিত্র্য বিশেষ করে শস্য বৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে। বহুজাতিক কোম্পানির মনোপলি বিজনেস শস্য বীজের বৈচিত্র্যকে ধংস করে দিচ্ছে। আগে সারা দুনিয়ার লক্ষ লক্ষ কৃষক নিজদের শস্য বীজ নিজেরাই সংগ্রহ, সঞ্চয়, পুনরুৎপাদন করত কিন্তু বর্তমানে মেধাস্বত্ব আইনের সুযোগ নিয়ে এসব বীজের মালিকানা বৃহৎ এগ্রো কর্পোরেশন নিজেদের করায়ত্তে নিয়ে আসায় কৃষকদের চড়া দামে পেটেন্টেড বীজ কিনে নিতে হচ্ছে। আবার বীজ ইঞ্জিনিয়ারিং ও বীজ মোডিফিকেশনের মাধ্যমে বীজের প্যাটেন্ট নিয়ে নিচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো, ফলে সারা দুনিয়ার কৃষিতে চালু হয়েছে বীজ আগ্রাসন। ৫০ বছর আগেও ভারতের কৃষকগণ প্রায় ৩০ হাজার জাতের ধানের চাষ করত, কিন্তু এখন মাত্র ১০ টি জাত ৭৫% ধান উৎপাদন কাভার করে।
বহুজাতিক কোম্পানি কর্তৃক এভাবে পেটেন্ট আগ্রাসনের ফলে পেটেন্ট আইনের বাস্তবায়ন শুরু হলে আমাদের জীববৈচিত্র্য এবং কৃষিতে বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। প্রথমত, বায়োপাইরেসির ফলে লোকায়ত জ্ঞানের প্রয়োগ এবং জেনেটিক সম্পদের ঐতিহ্যবাহী ব্যবহার বাধাগ্রস্ত বা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হবে। এসব উদ্ভিদ এবং শস্য বীজের বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও উৎপাদনের উপর বিধিনিষেধের ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো খাদ্য শস্যের উপর গবেষণা করতে পারবে না এবং খাদ্য নিরাপত্তা চলে যাবে প্রাইভেট কর্পোরেশনের হাতে। স্বত্ব পাওয়া কোম্পানি এসব শস্যবীজ, উদ্ভিদ এবং ওষধি গাছের সংরক্ষণ, উৎপাদন ও বিপণন বন্ধ করে দিতে পারবে। কৃষকদের নিজেদের জমিতে/খামারে বীজ সঞ্চয়, নবায়নকৃত ব্যাবহার এবং বিক্রয় নিয়ন্ত্রিত হবে পেটেন্ট আইনের কারনে। ফলে পেটেন্টেড শস্য বীজ ও অন্যান্য জৈবিক সম্পদ উৎপাদনের জন্য হয় বহুজাতিক কোম্পানিকে রয়্যালিটি দিতে হবে অথবা আমাদেরই উৎপাদন প্রণালীর অন্তর্ভুক্ত এসব দ্রব্যাদি উচ্চ দামে কোম্পানি থেকে কিনতে বাধ্য করা হবে। ফলে আমাদের মত উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোতে কৃষিজ পণ্য ও খাদ্য দ্রব্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাবে, হুমকির মুখে পড়বে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা। আর এসব পেটেন্টেড পণ্যের একচেটিয়া ব্যবসা করে অবাধে মুনাফা অর্জন করবে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো
৩। কালচারাল ক্ষতি ঃ এশিয়া ও আফ্রিকার জনপদের ট্র্যাডিশনাল কৃষি পদ্ধতির সাথে যুগপৎভাবে মিশে আছে এসব দেশের কৃষ্টি-কালচার-জীবনযাপনের বৈচিত্র্য। কৃষিতে কর্পোরেট আগ্রাসন তথা বায়োকলোনিয়ালিজম এই বৈচিত্র্যকে বিলুপ্ত করে দিচ্ছে এগ্রিবিজনেসের মাধ্যমে। কর্পোরেট এগ্রিবিজনেস কৃষির সাথে যে সংস্কৃতি ও জীবনযাপনের সম্পর্ক তা অস্বীকার করে এবং দুনিয়ার খাদ্য সমস্যা দূর করার নাম করে বীজ পেটেন্টিং এর মাধ্যমে চালু করে মনোকালচার ( বিচিত্র খাদ্য শস্যের বদলে কোম্পানি তার বাণিজ্যিক স্বার্থে হাতে গোনা কিছু শস্য উৎপাদনে বাধ্য করে) যা কৃষির প্রাণবৈচিত্র্যকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়। খাদ্য ও খাদ্য উৎপাদন কৃষকদের কাছে শুধু ভোগের বিষয় নয় এর সাথে কালচারের অনুষঙ্গ রয়েছে কিন্তু বহুজাতিক কোম্পানি কর্তৃক প্রাণ ও প্রতিবেশের বাণিজ্যিকীকরন ও পণ্যকরণ লোকালয় ভিত্তিক কৃষির প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়।
প্রাণ-উপনিবেশীকরণ প্রতিরোধে
নিওলিবারেল বিশ্বায়ন এখন লোকাল কমিউনিটির বায়োলজিকাল ও কালাচারাল ডাইভার্সিটি, ইকোসিস্টেম, মূল্যবোধ এবং জ্ঞান কাঠামোকে ধংস করতে উদ্যত। ফলে স্থানীয় জনপদের সংস্কৃতি, বিশ্বাস ও জীবন –জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে। অবিলম্বে তাই অনুন্নত দেশগুলোর ট্র্যাডিশনাল বীজ, হারবাল মেডিসিন, জ্ঞানকাঠামো এবং প্রাণবৈচিত্র্যের এই লুণ্ঠন ও প্যাটেন্টকরণ বন্ধ করতে হবে। প্রাণের ( উদ্ভিদ, প্রাণী, জিন) পেটেন্টকরণ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সম্পূর্ণ অবৈধ। ট্রিপস চুক্তি আবশ্যকীয় মেডিসিন ও অন্যান্য সেবার প্রাপ্যতা থেকে গণমানুষকে বঞ্চিত করবে এবং এসব জীবন রক্ষাকারী খাদ্য ও ওষুধের দখল, প্রাণবৈচিত্র্য, জেনেটিক সম্পদ ও ঐতিহ্যবাহী জ্ঞানের মালিকানা বহুজাতিকের কাছে চলে যাবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রাণের উপর প্যাটেন্টকরণ অথবা অন্যান্য বায়োলজিক্যাল সম্পদের উপর মেধাসত্ত আইন কার্যকর করা অবৈধ করা উচিত। জিন বৈচিত্র্য প্রাইভেত প্রোপার্টি হতে পারে না এবং ঐতিহ্যবাহী জ্ঞানের বায়োপাইরেসি অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।
খাদ্য নিরাপত্তা ও খাদ্য সার্বভৌমত্ব বজায় রাখা এবং তার সুরক্ষা দেয়া আবশ্যক। কৃষক সমাজের টেকসই কৃষি ব্যবস্থাপনাকে বজায় রাখার স্বার্থেই আন্তর্জাতিক ট্রেড নীতির আধিপত্য থেকে কৃষি খাতকে সুরক্ষা দিতে হবে। মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে কৃষকদের জীবন জীবিকা এবং গণমানুষের লোকাল অর্থনীতিকে বিধ্বস্ত করা যাবে না। খাদ্যের সহজ প্রাপ্যতার মৌলিক অধিকার তখনই বাস্তবায়িত হবে যখন লোকাল জনগণের খাদ্য সার্বভৌমত্বের নিশ্চয়তা বিধান করা সম্ভবপর হয়। এর মানে কর্পোরেট নয় বরং কৃষক ও স্থানীয় জনতাই তাদের নিজস্ব খাদ্যনীতি এবং কৃষি নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করবে এবং লোকায়ত জনগোষ্ঠীর নিজস্ব খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থাপনাকে বজায় রাখা হবে যার মাধ্যমে এসব জনপদের ঐতিহ্যবাহী কালচার, জ্ঞানকাণ্ড ও বৈচিত্র্যও সুরক্ষিত হবে।
বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য, সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার, কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা এবং হারবাল ওষুধ বিজ্ঞানকে বহুজাতিক কোম্পানির পেটেন্ট আগ্রাসন থেকে মুক্ত করতে হলে দরকার আমাদের লোকায়ত জ্ঞানের সংরক্ষন এবং রক্ষণাবেক্ষণ। এজন্য একদিকে সরকার এবং সচেতন মহলকে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার ট্রিপস চুক্তির ২৭.৩(খ) ধারা অনুযায়ী প্রাণ ও প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার পেটেন্টকরণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাতে হবে। বর্তমানে দক্ষিন আমেরিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ১১৮টি সংগঠন সব ধরনের প্রাণ ও জীবনের উপর পেটেন্ট বন্ধ করার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। প্রাণ ও জীবনের উপর পেটেন্টের বিপক্ষে তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের (মেক্সিকো, ভারত, দক্ষিন কোরিয়া) কৃষক ও আদিবাসীদের বিভিন্ন ফেডারেশন যে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করছে তার সাথে এদেশের কৃষক ও জনগণকে সম্পৃক্ত হতে হবে। সরকারকে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে অন্যায্য মেধাস্বত্ব অধিকার আইন বাতিলের জন্য কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হতে হবে।
তথ্যসূত্র
১। Spivak, G. (2000). The New Subaltern: A Silent Interview. In: Chaturvedi, V. ed. Mapping subaltern studies and the postcolonial. London, Verso. pp. 324-340
২। Butt, H. (2012). “Cultural symbols, biocolonialism and the commodification of rural and indigenous bodies”. http://www.e-ir.info/2012/01/18/cultural-symbols-biocolonialism-and-the-commodification-of-rural-and-indigenous-bodies/
৩। Greenfield, G. (1999). “The WTO, the world food system, and the politics of harmonised destruction”, www.labournet.org/discuss/global/wto.html.
৪। McMichael, P. (1995). “The ‘new colonialism’: Global regulation and the restructuring of the inter-state system.” In D. Smith and J. Borocz (eds.), A New World Order? Global Transformations in the Late Twentieth Century (pp. 37–56). Westport: Greenwood Press.
৫। McMichael, P. (2000). “The power of food”. Agriculture and Human Values 17:21-33.
বি দ্রঃ [এই লেখাটি " বিবিধ" পত্রিকায় মে ২০১৪, ৪ র্থ বর্ষ ১২ তম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে]
যোবায়ের আল-মাহমুদ

Sunday, April 19, 2015

ঘরেই চাষ করুন "আদা", কোন রকম বাড়তি পরিশ্রম ছাড়াই!

মসলাপাতির মাঝে আদার দামটা একটু চড়াই বটে। তবে দামের চাইতেও জরুরী ওষুধমুক্ত, সতেজ আদা পাওয়া। হরেক রকম মরিচ থেকে শুরু করে ক্যাপসিকাম, আজকাল অনেকেই এসব লাগান নিজের বারান্দায়। কিন্তু কখনো আদা চাষের কথা ভেবেছেন কি? কোন ধরণের পরিশ্রম ছাড়াই নিজের বারান্দা, ছাদ, রান্নাঘর, এমনকি জানালার ধারেও চাষ করতে পারবেন আদা। কীভাবে? চলুন, জেনে নিই পদ্ধতি।

ধাপ-১

আদা থেকে গাছ গজাতে হবে প্রথমে। এই কাজটি করার জন্য আদাকে
প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে ফ্রিজে রেখে দিন। কিছুদিন পর দেখতে পাবেন যে আলুতে যেমন গাছ বা "চোখ" গজায়, তেমনই গাছ গজিয়েছে। প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত করতে পানি ও পটাশিয়াম পারমাঙ্গানেটের (ফার্মেসিতে কিনতে পারবেন) পাতলা দ্রবনে আদাকে কয়েক ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখুন। তারপর ফ্রিজে রাখুন।

ধাপ-২

গাছ গজিয়ে গেলে আদাকে টুকরো করে নিন। প্রত্যেক টুকরোয় কমপক্ষে একটি গাছ যেন থাকে, সেটি খেয়াল রাখবেন।

ধাপ- ৩

এবার লম্বাটে টবে বা পাত্রে আদা রোপন করুন। পানি বা তেলের ৩-৫ লিটারের বোতলগুলো বেশ ভালো কাজে আসবে। সমান সমান পরিমাণ মাটি ও জৈব সারের সাথে অর্ধেক পরিমাণ বালু মিশিয়ে আদার জন্য মাটি তৈরি করুন। কিংবা আপনার ঘরে ভালো মাটি থাকলে সেটাটেই সার মিশিয়ে রোপন করুন। একটি পাত্রে একাধিক আদার টুকরো রোপণ করুন। পাতলা প্লাস্টিক দিয়ে ঢেকে দিন। গাছ মাটির ওপরে বেরিয়ে আসলে প্লাস্টিক সরিয়ে দেবেন।

ধাপ-৪

নিয়মিত পানি দেবেন, তবে খুব বেশী নয়। ২/৩ দিন পরপর। বেশী পানি দিলে আদা পচে যাবে। পর্যাপ্ত আলো-বাতাসে রাখুন।

ধাপ-৫

আদা রোপণের জন্য ভালো সময় ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত। রোপণের ২/৩ মাসের মাঝেই গাছ গজাবে। ভালো অবস্থায় গাছ ১ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। হেমন্তে গাছ যখন শুকিয়ে যাবে, তখন মূল টেনে তুলে নিন। এই মূলটিই হচ্ছে আদা। গাছটা মোটামুটি বেড়ে উঠলেই বুঝবেন যে আদা তোলা যায়। আদা ম্যাচিউর হয়ে গেলে আপনি গাছ টেনে তুলে প্রয়োজনমত খানিকটা আদা নিয়ে আবার লাগিয়ে রাখতে পারেন। যতদিন গাছ মরে না যাচ্ছে, আদা বড় হবে।
পরিষ্কার করে সংরক্ষন করুন। বেশ কয়েক মাস পর্যন্ত ব্যবহার করতে পারবেন। গুঁড়ো করে রাখলে সারা বছর থাকবে।